1
আজ থেকে ঠিক একবছর আগের কাহীনি.....
SSC testপরীক্ষার result এর পর সব ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা নিয়ে তুমুল ব্যাস্ত,সেই সাথে সকল স্কুল শিক্ষকরাও পার করছেন ব্যাস্ত সময়,,,তাঁরা নিয়মিত খাবার খাওয়ার সময়টাও পাননা,,সারাক্ষণ তাদের বাসায় স্টুডেন্ট বসে থাকতে দেখা যায়,,,কিন্তু তাতে সবার ব্যাক্তিগত স্বার্থই বিদ্যমান,,,
তেমনি একজন বেসরকারি স্কুলের গনিত শিক্ষক শরিফ স্যার,,সারাক্ষণ স্টুডেন্ট নিয়ে ব্যাস্ত,, নিজের স্কুলের স্টুডেন্ট ছাড়াও সরকারি সব স্কুল সহ অন্যান্য স্কুলের ছাত্রছাত্রী দিয়ে মুখরিত থাকে তাঁর বাসার প্রাঙ্গণ ।যদিও তাঁর কাছে নিজের স্কুলের স্টুডেন্টস দের গুরুত্ব বেশি,,এর অবশ্য অন্য হেতুও আছে,,
যাইহোক ছাত্রছাত্রী দের স্পেশাল কেয়ার এর জন্য তিননি বাসায় অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষক রেখে স্টুডেন্টসদেরকে পড়ান,,,
তেমনি একদিন দেবাশিষ নামে একজন শিক্ষক এর পিজিক্স পড়ানোর পরে শরিফ স্যার নিজের স্কুলের স্টুডেন্টস দের বসতে বলে বাকিদের বিদায় দিয়ে কিছু জরুরী কথা বললেন:
:কি কেমন চলছে তোমাদের পড়াশোনা?
:জ্বি স্যার,খুব ভালো(সকলে)।
শরিফ স্যার আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে চেয়েও করলেন না,,বরঞ্চ সরাসরি আসল কথায় চলে গেলেন,
:আচ্ছা তোমরা সবাইতো জানো আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকরা কেনো আমার প্রতি রেগে আছেন?? গতবছর আমাদের স্কুলের বিজ্ঞান শাখার SSC RESULT একদম ভালো হয়নি,,,আর এইবছর বিজ্ঞানের অধিকাংশ স্টুডেন্টস আমার কাছে চলে এসেছ,,তাঁদের ধারনা এইবছর ও তাই হবে,,,এজন্যে তোমাদের নিয়ে আমি খুব চিন্তিত।
: (স্যারের কথার মাঝখানে একছাত্র বলল) স্যার,আপনি আমাদের যেভাবে চলতে বলেন সেভাবেই চলব,,যা করতে বলবেন তাই করব।
:(সব ছাত্রছাত্রী বলল) জ্বি সার তাই করব।
: না তোমাদের আমি তেমন কিছুই করতে বলবনা,,আমি শুধু চাই টেস্ট পরবর্তী এই সময়টাকে তোমরা ঠিকভাবে কাজে লাগাও।
: জ্বি স্যার,,
:আজ যে জন্যে তোমাদের বসতে বলছি সেটা হচ্ছে এখন তোমাদের একটা প্রস্তুতি কোচিং করা দরকার,,আর এজন্যে প্রত্যাশা কোচিং এর পরিচালক শামীম স্যার এর সাথে আমি কথা বলেছি।
অবশ্য তোমরা হয়ত অনেকেই জানো যে ঐ কোচিং এ আমি গনিত পড়াই,,তাই ঐখানে পড়লে আমি তোমাদের সরাসরি তত্ত্বাবধান করতে পারব,,,তোমরা কি বলো?? আর দেবাশিষ স্যারকেও ঐখানে নেয়া হবে পিজিক্স পড়ানোর জন্য।
: সব ছাত্ররাই সন্তোষেরর সংগে জবাব দিল,,জ্বি স্যার আমরা ঐখানে পড়তেই রাজি,,
: আচ্ছা তাহলে ঠিক আছে দ্রুত ভর্তির কাজ শেষ করেই শামীম স্যারকে বলব কোচিং এর শিডিউল ঠিক করে ফেলতে,,কেমন??
: আচ্ছা স্যার,,
এতক্ষণ সকল স্টুডেন্টরাই শরিফ স্যারের কথায় জ্বি হ্যা করলেও রিমা লক্ষ্য করল হৃদয় একবারো জ্বি কিংবা হ্যা বলেনি,,রিমা হৃদয়ের ঘনিষ্ঠ একজন কেউ,,এর কারনটা অবশ্য তারা দুজনের বাড়ি পাশাপাশি,,,যাকে বলে হাত বাড়ালেই ধরা যায়,
হৃদয়ের পরিচয় সে খুব দরিদ্র পরিবারের সন্তান,কিন্তু খুব মেধাবী,ক্লাস ৭ থেকে এইপর্যন্ত স্কুলে কেউ তাকে টপকাতে পারেনি,,তাছাড়া ৫ম শ্রেণীতে বৃত্তি সহ 2014 সালে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা বিষয়ক কর্মসূচি,"জাতীয় সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায়"সে তার উপজেলা ও জেলার মাঝে বিজ্ঞান বিভাগে বছরের সেরা মেধাবীর খেতাব এবং "বাংলাদেশ ও সাধারন জ্ঞান" বিভাগে বছরের তৃতীয় সেরা মেধাবী খেতাব অর্জন করে ঢাকায় গিয়ে পরিক্ষা দেয়,
ঢাকা নিয়ে যাওয়ার জন্য অবশ্য স্কুল থেকে শরিফ স্যার এর উপর দায়িত্ব পড়েছিল।
আর রিমা মেয়েটার পরিচয় সে ধনীর দুলাল,পড়াশোনায় মোটামুটি,তবে খুব আত্মসচেতন আর ভাবুক,,,অল্পতেই অনেক কিছু বুঝে ফেলার ক্ষমতা তার আছে,,
রিমা হৃদয় কে ফ্রেন্ডের মত দেখে আর অনেক নজরও রাখে,,
রিমা হৃদয়কে এমন বিষন্ন দেখে জিজ্ঞেস করল: কিরে আইনস্টাইন,কি ভাবস?কি হইসে?
হৃদয়: কিছু না।
: কোচিং করবি না?
রিমার কথাগুলো শরিফ স্যারের কানে গেল,তিনি এমনটা শুনে হৃদয়কে তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করলেন,
: কি হৃদয়,কোচিং করবা না,,কোনো সমস্যা?
: জ্বি স্যার,(নিচু গলায় জবাব দিল)
: কী সমস্যা বলো আমায় শুনি?
: অসুস্থ স্যার,
: কি অসুখ তোমার বলো?
: (আস্তে করে বলল) অ্যাজমা স্যার।
: শরিফ স্যার হৃদয়ের এই রোগটা সম্পর্কে জানতেন,তাই সংক্ষেপে বললেন) ও আচ্ছা।
তারপর শরিফ স্যার হৃদয়কে বসতে বলে সবাইকে ছুটি দিয়ে দিলেন,
: অনেক কথা হলো,,এবার তোমরা সবাই বাসায় যাও,,কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে তারপর পড়তে বসতে হবে সবার,,প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।
সবাই সবার মত চলে গেল শুধু হৃদয় থেকে গেল।
আরেকজন অবশ্য বাইরে দাঁড়িয়ে আছে,সে হচ্ছে রিমা,
প্রতিদিন তারা দুজন একসাথে বাসায় ফিরে তাই সে দাঁড়িয় অপেক্ষা করছে
সবাই চলে যাওয়ার পর শরিফ স্যার হৃদয়কে বলল: তুমি কোচিংয়ে আসবা আর প্রতিদিনি আসবা,তোমার সব সমস্যা আমি দেখব,
হৃদয় শুধু খানিকটা ঘাড় নাড়ল,
: আচ্ছা আজ তাহলে বাড়ি যাও,দেরি হয়ে যাচ্ছে,এটা বলে শরিফ স্যার অন্যমনস্ক হতেই হৃদয় সালাম দিয়ে বের হয়ে আসল,
রিমার সামনে পড়তেই তার কেমন লজ্জা করতে লাগল,
রাস্তায় রিমা অনেকবার জিজ্ঞেস করাতেও হৃদয় কোনো উত্তর দিলনা যে স্যার তখন তাকে কি বলেছিল,
সে কোনো কথা না বলেই সোজা বাসায় চলে আসল।
2
হৃদয় যে স্কুলে পড়ে সেস্কুলে মেধাবী ছাত্রছাত্রী দেরকে অনেক সুবিধা দেয়া হয়,প্রত্যেক ক্লাসের সেরা ছাত্রকে মাসে ২হাজার টাকা করে বছরে ২৪হাজার টাকা স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যাক্তির পক্ষ থেকে মেধাবৃত্তি প্রদান করা হয়। আর টাকাটা প্রদান করা হয় তিনমাস অন্তর অন্তর।
সেদিন স্কুল থেকে স্কলারশিপ এর টাকা নিয়ে বাড়িতে এসে হৃদয় দেখে তাদের উঠানে একলোক একটা লম্বা খাতা হাতে চেয়ারে বসে আছে,লোকটাকে চিনতে হৃদয়ের একটুও কষ্ট হলনা,সে লক্ষ্য করল লোকটার পাশেই তার বাবা একটা পিঁড়িতে বসে আছে,
হৃদয় তাদের কাছে আসতেই তার বাবা মুখে হাসির রেখা টেনে বলতে শুরু করল
: কইছিলাম না স্যার,ইকটু বন,আমার ছেরা আইজ্জ ইস্কুলে টেহা পাইবো,
কইছিলাম না আপনের কিস্তি আমি আটকামোনা,
কই হৃদয় টেহাডা দে,স্যার রে আগে বিদায় কইরা লই,
কিস্তিলোক:( বিরক্তিভাব করে) কই দেন টাকা দেন।
হৃদয়ের কেনো জানি টাকা দিতে মায়া হচ্ছিল আর খানাকটা ক্রোধও জন্ম নিচ্ছিল। তবুও সে টাকাটা তার বাবার হাতে দিয়ে পাশে দাঁড়ালো।
কিস্তওয়ালা কিস্তি বুঝে পেয়ে অনেকটা স্বস্তির সংগে জিজ্ঞেস করল কিসে পড়ে আপনার ছেলে?
:জ্বি স্যার,চৌহিতে বয়ে পড়ে,কোনো টেবিল নাইত তাই,,ভাবতাসি এইবার টেহা দে একটা টেবিল বানামু,
এমনটা শুনে কিস্তওয়ালা হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে হালকা ভ্রু কুচকালো,যেনো এমন মুর্খ সে জিবনে দেখেনি।
তৎক্ষণাৎ হৃদয় উত্তর দিল,এইবছর SSC দিব।
কিস্তওয়ালা : ও,,তা ভালো করে পড়াশুনা কইরো বুঝছ,,ভালোভাবে পড়াশুনা করলে জীবনে সফল হওয়া যায়,,জীবনটা তখন অনেক মূল্যবান হয়ে যায়,,তখন দেখবা সবাই তোমাকে কত সম্মান করে।
: জ্বি
: তা শুনলাম তোমাদের স্কুলে নাকি প্রতিবছর Ssc তে সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট ধারীকে অনেক টাকা স্কলারশিপ দেয়া হয়?
: জ্বি,১লক্ষ টাকা এককালিন দেয়া হয়।
: হুম অনেক টাকাই তাহলে দেয়,যাইহোক তুমি ভালো
করে পড়াশোনা করো।পড়ালেখায় কোনো গাফলত রাখবা না।
আচ্ছা আজ তাহলে যাই বলে তিনি চলে গেলেন।
হৃদয়ের বাবা এতক্ষণ শুধু তাদের কথা শুনছিল আর হা করে ছিল,কিছু বুঝেছে কিনা কে জানে।
দুপুরের খাবারের পর হৃদয় খানিকটা লজ্জা নিয়েই তার বাবার কাছে কথাটা পাড়ল:
:আব্বা,শীত আয়ে পড়ছে,,ডাক্তারে কইছিন শীতের মাঝে শরীরে ঠান্ডা লাগানি যাইতনা,নইলে অ্যাজমা বাড়ব। এই লাইগ্গে এহন একটা ভালো দেইখে সোয়েটার কিনা লাগব।
:(তার বাবা বিস্ময়ের সঙ্গে বলল) কেরে আগের সোয়েটার কি করচস? আর ডাক্তাররাতো কত কিছুই কয়,হেরার কামেইতো এডা।
: হ ৫০টেহা দামের পুরান একটা সোয়েটার খালি সারাজিবন থাকব?এইটাত অনেক আগেই ছিঁড়া গেছে।
আমার অসুখ হইছে আমি বুঝি কেমন কষ্ট লাগে, যহন দম নিতে পারিনা তহন কষ্টে মন চায় নিজের জীবন নিজে দিয়ে দেই।
হৃদয়ের মুখে এমনটা শুনে তার মা চুপ করে থাকতে পারেনি,তিনি জোর গলায় বললেন সোয়েটার কিনে দিতে হবেই আর তাতেই তার বাবা রেগে গিয়ে দুজনের মাঝে বিতর্ক শুরু হয়ে গেল,: আমার বাপ কি জমিদার আসিন নি যে দুইদিন পরপর সোয়েটার কিন্নে দেওন লাগব? কামাই কইরা দেহক কেমন কষ্ট লাগে।
: সময় হইলেত কামাই করবই,আজকে ওস্কুলে যে টাকা পাইছে সেখান থেকে কিনে দিওন লাগব।
হৃদয়ের বাপ বিতর্কে না গিয়ে বলল আইচ্ছা আজ ওরে কইস আমার সাথে যাইতে,কিননে দিমুনে।
হৃদয় এতক্ষন দাঁড়িয়ে তার বাবার নির্মম কথাগুলো শুনছিল,এইটা শুনামাত্র সে ঘর থেকে বের হয়ে আসল।
প্রতেক মানুষেরি কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট আছে।তেমনি হৃদয়ের বাবারও কতকগুলা আছে,তিনি এমন একজন লোক যে তার সামনে যদি তার ছেলে অ্যাজমায় দম বন্ধ হয়ে মারাও যায় তাহলেও সে তাতে কোনো মাথা ঘামাবে না,তখনি তিনি হৃদয়কে ডাক্তারের কাছে নিবেন যখন কেউ এসে তাকে বলবে যে ছেলেটার অবস্থাতো খুব খারাপ অথবা যখন হৃদয়ের মা খুব কান্নাকাটি করতে শুরু করবে তখন।
যাইহোক সেদিন হৃদয়ের বাবা হৃদয়কে একটা দামি ব্লেজার কিনে দিয়েছিলেন। অবশ্য কখনোই কিনে দিতেন না, যদি না হৃদয় তার বাবাকে প্রচণ্ড চাপ না দিত।
ব্লেজার টা খুব দামি হলেও হৃদয়ের বাবা সেটা কিনে ছিল অর্ধেকের চাইতে কম দামে যদিও সেটা একদম নতুন ছিল।
কিভাবে এমন দামে কিনল তা জিজ্ঞেস করায়,হৃদয়ের বাবার উত্তর শুনে তার বুকে কেমন একটা যেন হাহাকার বয়ে গেল।
তিনি এমনভাবে ব্লেজার টা কিনেছেন যাকে বলে পরোক্ষ ভিক্ষা বৃত্তি।
ব্লেজার পেয়ে হৃদয় যারপরনাই খুশি হয়েছিল তাই সে ঐ বিষয়ে আর মাথা ঘামালো না।
3
কোচিং প্রায় শেষের দিকে। আর এদিকে SSC পরিক্ষাও খুব কাছে চলে এসেছে।
এমন সময় হঠাৎ কোচিং এর ফিস দেওয়ার জন্য তাগাদা আসতে থাকল। যদিও সবাই অনেক আগেই দিয়ে দিয়েছে।
রিমা হঠাৎ তাকে জিজ্ঞেস বরে বসল
: কিরে কোচিং এর ফিস দিসস?
: হৃদয় নিচু গলায় বলল) না দেইনি।
: কালতো তুই কোচিং এ আসিশ নি,কাল শামীম স্যার বলছিল সবার টাকা পরিশোধ করার জন্য।
: ও আচ্ছ।
এরপরের দিন হৃদয় বহুকষ্টে তার বাবাকে চাপ দিয়ে ২হাজার টাকা নিয়ে শরিফ স্যারের কাছে গেলে শরীফ স্যার টাকাটা রাখল না। বলল,:হৃদয় তোমার বিষয়টা আমি জানি,,আর শামীম স্যার এর সাথে তোমার ব্যাপারে আমি কথাও বলেছি। তাছাড়া আমি তোমাকে একদিন বলছিলাম তোমার সব সমস্যা আমি দেখব।
হৃদয় শুধু জ্বি স্যার বলে বেরিয়ে আসতে চাইল,,কারন সে জানে টাকাটা তার বাবা একজনের কাছ থেকে ঋন করে তাকে দিয়েছিল। তাই সে দ্বিতীয় বার আর স্যারকে জোর করল না।
হৃদয় চলে আসার সময় স্যার তাকে একটু বসতে বলে অনেক কথা বলল,
সব অবশ্য প্রাইভেট পড়ানো বিষয়ে। কেনো তিনি প্রাইভেট পড়ান এইসব।
হৃদয়ের বুঝতে বাকি রইল না যে স্যার তাকে কেনো এসব বলছেন।
তাই সে অনেকটা জোর করেই স্যার এর হাতে ১হাজার টাকা দিয়ে বের হয়ে আসল।
তারপর খুব ভালোভাবেই SSC পরিক্ষা শেষ হয়ে গেল। মাঝখানে অবশ্য একটা তুচ্ছ ঘটনা ঘটে গেল। পরিক্ষার হলে রিমার ডাকে সাড়া না দেওয়ায় রিমা তার সাথে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছে।রিমার মতে হৃদয় একটা স্বার্থপর। হৃদয় কে দেখলে সে এখন দূর থেকেই অন্যদিকে চলে যায়। তাতে অবশ্য হৃদয়ের কিছু যায় আসেনা।
৪
রেজাল্ট দেয়ার আর মাত্র একটা রাত বাকি।
হৃদয় শুয়ে আছে। ঘুম আসছে না,মাথায় হাজার হাজার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে,আর তার আজ চিন্তা করতে অনেক ভলোও লাগছে। কোনো বিরক্তিভাব আসছে না।
হঠাৎ তার মাথায় আসলো রিমা তাকে একদিন বলছিল,
তুই একটা স্বার্থপর,আমার সাথে আর কোনোদিন কথা বলবি না।
তার পর অবশ্য আর কথাও হয়নি।
কিন্তু আজ তার হঠাৎ স্বার্থপর বিষয়ে চিন্তা করতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।
পৃথিবীতে কে কে স্বার্থপর অার কে কে স্বার্থহীন এটা চিন্তা করতে আজ তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে। পৃথিবীতে কি সে একাই স্বার্থপর নাকি আরো কেউ আছে?
তার মনে প্রশ্ন জাগল,আচ্ছা শরিফ স্যার কি স্বার্থহীন?
অনেক চিন্তা করে বের করল,না তিনি স্বার্থহীন হতে পারেন না কখনো।
আচ্ছা রিমা কি স্বার্থহীন?? স্বার্থহীন হলেত ও কখনো এমন করতনা।
আর আমিত বিরাট স্বার্থপর,নইলে কখনো ব্লেজার এর জন্য
নিজের বাবাকে কখনো হীন করতে পারতাম না।
আচ্ছা আমার বাবা কি স্বার্থপর?? স্বার্থপর হলে তিনি কেমন স্বার্থপর??
এমনটা চিন্তা করতে করতে হৃদয় হঠাৎ নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পরে।
ঘুমিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই সে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল,স্বপ্ন টা হচ্ছে এরকম::-
হৃদয় দেখল, আজ তার রেজাল্ট বের হয়েছে,সে তার স্কুলে সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছে,,সবাইকে পেছনে ফেলে সে প্রথম হয়েছে.।সেই খুশিতে সে আত্মহারা,চারদিকে সে শুনতে পেলো তার নামে কত কত সুনাম করা হচ্ছে,,সবাই তাকে নিয়ে অনেক অনেক গর্ব করছে। তখন সে সবার মাঝে তার বাবার মুখ খানি দেখতে পেলো,যেনো তিনি খুশিতে আর গর্বে ভীষনরকম উল্লাসিত। হৃদয় তার বাবাব এমন উজ্জ্বল চেহারা আর কখনো দেখতে পাইনি। তখন সে দেখল তার বাবা ছেলের এমন সাফল্যে অনেক টাকা খরচ করে সারা এলাকার মানুষকে দাওয়াত করে খাওয়াচ্ছেন। আর সেখানে তত্ত্বাবধান করছে হৃদয় নিজেই। হঠাৎ তার চোখ পড়ল রিমার দিকে,রিমা তার বাবাসহ দাওয়াত গ্রহন করতে এসেছে।
রিমা হৃদয়ের দিকে এগিয়ে এসে বলল,,
:কিরে আইনস্টাইন,কনগ্রাচুলেশন।
:থ্যাংকস,কিন্তু তর সাথে আমার কোনো কথা নেই,তুইতো বলছিলি কথা না বলতে এজন্যে,,
: ও ওটাতো আমি রেগে বলছিলাম,,তুই এখনো ঐটা নিয়ে আছিস? আচ্ছা যা ঐ কথা আমি ফিরিয়ে নিলাম।
রিমার এই কথা বলার সাথে সাথেই স্বপ্নটা কেমন জানি পরিবর্তন হয়ে গেলো,
চারদিকে অনেক মানুষের পরিবর্তে চারদিকে শুধু সুনসান নিরবতা দেখা যাচ্ছে,,হৃদয় দেখতে পেলো একটা মাঠের দিগন্তে সে শিক্ষাবৃত্তির টাকা দিয়ে কেনা একটা নতুন ঝালরওয়ালা সুন্দর সাইকেল চালিয়ে মনের খুশিতে গান গাইতে গাইতে হিমেল বাতাসে তাল মিলিয়ে ছুটে চলছে। হঠাৎ নীল আকাশের দিকে চোখ পড়ায় সে দেখল তাকে লক্ষ্য করে করে একটা মায়াবি পরি আকাশে উড়ছে,,আর হাত বাড়িয়ে তাকে ডাকছে। হৃদয় ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখল এযে আমাদের রিমা,,,রিমা বুঝি পরি রাজ্যের মেয়ে?তাই সে এখন আমাকেও পরিরাজ্যে নিয়ে যেতে এসেছে?
পরক্ষনে স্বপ্ন পট আবার পাল্টে গেল,হৃদয় নিজেকে আবিষ্কার করল সে এখন শরিফ স্যারের বাসায় বসে আছে। শরিফ স্যার তাকে নিজ হাতে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন আর বলছেন তুমি আমার মান রেখেছ হৃদয়।হৃদয় শুধু জবাব দিল: জ্বি স্যার।
কিছুক্ষণ পর হৃদয় বুঝতে পারল শরিফ স্যার তাকে যে মিষ্টি খাওয়ালেন তা হৃদয় নিজেই শরিফ স্যারের জন্য স্কুল থেকে শিক্ষাবৃত্তির টাকা পেয়ে এনেছিল।
হঠাৎ হৃদয় তার বাবাকে শরিফ স্যারের বাসায় দেখতে পেল,,তিনি খালি গায়ে কেবল একটা ছেঁড়া লুঙ্গী পরে আছেন। আগের চাইতে অনেক বৃদ্ধ হয়ে গেছেন আর হাঁপানি রোগির মত জোরো জোরে শ্বাস নিচ্ছেন,,যেনো অনেক কষ্টের পর শ্বাসটা ফুসফুসেরর ভিতরে ঢুকাতে পারছেন।
পরক্ষনেই হৃদয় দেখতে পেল তার বাবা রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করছেন। কারও কাছে গিয়ে বলছেন,বাবা আমার হাঁপানি,,যখন দম নিতে পারিনা তখন খুব কষ্ট হয় আমার, বাবা আমায় কিছু টাকা দেন বাবা ওষুধ কিনে খাবো।
অথবা কারো কাছে গিয়ে বলছেন,
বাবা আমি দুদিন ধরে কিছু খেতে পাইনি। আমাকে কিছু খাবার ভিক্ষা দিন।
এদের মাঝে হৃদয় দেখল কেউ কেউ তার বাবাকে ভিক্ষা দিচ্ছে অথবা কেউ ধুর ধুর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে।
সবশেষে হৃদয় দেখল,,তার বাবা সবার কাছে হাতজোড় করে বলছেন,বাবা আমার ছেলেটা টাকার অভাবে লেখাপড়া করতে পারছেনা,,ছেলেটার লেখাপড়া করার খুব ইচ্ছে ছিল কিন্তু আমি জীবনে তার কোনো ইচ্ছেই পূরন করতে পারিনি। ভালোমতো একটা কাপড় পরতে দিতে পারিনি। ছেলেটা আমার অ্যাজমায় দম বন্ধ হয়ে মরতে বসে কিন্তু মুখে একটু ওষুধ দিয়ে কষ্টটা লাঘব করাতে পারিনা,,ছেলেটা আমার কিচ্ছু বলেনা,শুধু আমার মুখের দিকে করুনভাবে তাকিয়ে থাকে,,তখন কষ্টে আমার বুকটা ফেটে যায়। এসব বলেই হৃদয়ের বাবা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন সবাই আমাকে কিছু ভিক্ষা দেন বাবারা,,,ভিক্ষা।
হৃদয় তার বাবার এমন সব দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিল যেনো তার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল । তার ইচ্ছে হচ্ছিল গলা ফাটিয়ে বলতে,না বাবা না,,তুমি ভিক্ষা করতে পারোনা,কখনোই পারোনা এমন করতে।এই নাও বাবা আমার শিক্ষাবৃত্তির পুরা টাকা তোমায় দিলাম,,এই টাকা শুধু তোমার জন্য বাবা,,আর কারো অধিকার নেই এখানে। বাবা.........
কিন্তু হৃদয়ের গলা থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছিল না।তার যেনো দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল,যেনো সে এখনি দম আটকে মারা যাবে।
হঠাৎ প্রবল শ্বাসকষ্ট নিয়ে হৃদয়ের ঘুম ভেঙ্গে গেল।
সে নিজেকে একটা সরু চৌকিতে ঘর্মাক্ত অবস্থায় আবিষ্কার করল।
৫
Ssc রেজাল্ট বের হয়েছে আজ দুদিন। হৃদয় তার স্কুলে সেরা হয়েছে। চারদিকেই শুধু হৃদয়ের জয়ধ্বনি। আর চারদিকে যেনো কেউ ঢাকঢোল পিটিয় প্রচার করে দিয়েছে যে হৃদয় স্কুল থেকে ১লক্ষ টাকা শিক্ষা বৃত্তি পাবে।
তাই হৃদয়কে যে যেখানেই দেখে শুধু বলে কিরে হৃদয় মিষ্টি কই??
সে কোনো জবাব দিতে পারেনা শুধু মুচকি হাসি দিয়ে সবাইকে সন্তুষ্ট করকে চায়,কারন সে জানে তার বাবার হাতে এলাকাজুড়ে মিষ্টি বিতরনের মত টাকা কখনোই হবেনা।
তাই রেজাল্টের দুদিন পর হৃদয় আজ ঘরবন্দির মত বসে আছে। বাইরে যেতে সাহস করেনা।
এদিকে হৃদয়ের বাবা অস্থির হয়ে গেছেন কখন তিনি শিক্ষা বৃত্তির টাকাটা হাতে পাবেন। তিনি এখন সমাজে এমনভাবে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করেন যেনো তিনি রীতিমত বড়লোক বনে গেছেন।
এদিকে অনেকদিন হয়ে গেলো কিন্তু হৃদয়ের শিক্ষা বৃত্তির টাকা দেওয়ার কোনো নাম গন্ধ নাই।
এর মাঝখানে অবশ্য ঐ প্রভাবশালী ব্যাক্তি যার পক্ষ থেকে টাকা প্রদান করা হয়, তিনি কয়েকবার স্কুল পরিদর্শন করে গেছেন।
তখন অবশ্য হৃদয় আর হৃদয়ের বাবার ডাক না পড়লেও হৃদয়ের বাবা সেখানে গিয়ে যথারীতি হাজির হয়েছেন। কিন্তু কখনোই টাকা দেওয়ার ব্যাপারে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি।
আর এদিকে দিন যতই যাচ্ছে হৃদয়ের বাবার অস্থিরতা ততই বেড়ে চলছে।
একদিন তিনি হৃদয়েকে বললেন,: কিরে টেহাতো এখনো দিলনা,,কোনোসময়িত টেহা দিতে এত দেরি হয়না। তাহলে এইবছর এমন হইতাছে কেরে?
:মনে হয় কোনো সমস্যা হয়ছে তাই দিতে দেরি হইতাছে আব্বা।
: কি সমস্যা হয়ছে তাতো আমি আন্দাজেই বুঝতাছি। আমি আজকেই এলাকার কয়েকজনরে লয়ে ইস্কুলে যাইবাম। দেখবাম কি হয়ছে।
: যাওনের কি দরহার। অযথা সম্মানহানি,ওরা ভাবব না খায়ে মরতাছি তাই টাকাটা নিতে পাগল হয়ে গেছি। আর যদি যিনি টাকাটা দেন তিনি এইবার টাকা না দিতে চান তাহলে আমরারি বা কি করার আছে?
: (রেগে গিয়ে) থাপড়ায়ে দাঁত ফালায়া দেম জমিদারের বাইচ্চা। ঐ টেহাডা আমরার প্রাপ্য তাই টেহাডা নেম। তরে কইছে না কেউ অত ফাল পাড়তে।
এইটা বলে হৃদয়ের বাপ চলে গেল,আর হৃদয় আগের মতই দাঁড়িয়ে রইল একটা চৌকির পায়ায় ভর করে।
মাঝরাতে হঠাৎ হট্টগোল শুনে হৃদয়ের ঘুম ভাঙ্গল। সে শুনতে পেল তার বাবা চিৎকার করে করে কিসব যেনো বলছে,,মনে হচ্ছে যেনো উনার জীবনের সবচেয়ে ক্ষয়কারী ঘটনাটা আজ ঘটেছে।
হৃদয়ের বুঝতে কিছুই বাকি রইলো না যে আসলে কি হয়েছে। সে খুব সহজেই বুঝে গেল যে তার প্রাপ্য টাকাটা দিয়ে জুয়োচুরি খেলা হয়েছে,,আর সে খেলায় অংশগ্রহন করেছে সর্বভুক জাতীয় প্রানিরা।
হৃদয় নিজেকে নিজে স্বান্তনা দিল যে সমাজের সর্বভুক প্রানিরা সর্ব কিছুই খাবে এটাই তাদের নিয়ম।তারা হৃদয়ের মত নিষ্পাপ জীবন টা খেতেও দ্বিধাবোধ করেনা। তাদের কাজে বাধা দেওয়ার মত এ সমাজে কেউ নেই।
হৃদয়ের মাথাটা কেমন জানি ধরে আসছিল আর শ্বাস নিতেও প্রচন্ডরকম কষ্ট হচ্ছিল। সে ঘুমাতে চেষ্টা করল কিন্তু ঘুমাতে পারল না,,।তাই সে নিজের ইচ্ছাতেই রেজাল্টের আগের রাতের সেই স্বপ্ন টা দেখতে চেষ্টা করল। ঐ ম্বপ্নটা তার কাছে কেমন জানি অদ্ভুত অদ্ভুত লাগে। তাই সে প্রায়ই সেই স্বপ্ন টা দেখতে চায়। আজও সে তাই ই চাচ্ছে। সে ভাবে স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকার মজাই আলাদা।